২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার,রাত ৮:০১

শিরোনাম

অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার

প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২২

  • শেয়ার করুন

 

গত রোববার খোলাবাজারে মার্কিন ডলার ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৫ টাকার মধ্যে কেনাবেচা হয়েছে। অন্যদিকে ডলারের দাম আনুষ্ঠানিক ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা হলেও ব্যাংকিং চ্যানেলেও মুদ্রাটির দর ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। এভাবে ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্য বিদেশি মুদ্রা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুদ্রার দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কুয়েতি দিনার, সৌদি রিয়াল, আরব আমিরাতের দিরহাম, কাতারি রিয়াল এবং ওমানি রিয়াল। এতে আমদানি পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করেন তারা।

জানা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে কুয়েতি দিনারের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৩ টাকা। রোববার প্রতি কুয়েতি দিনারের বিনিময় হার ৩৩৩ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এক মাস আগে এক দিনারের বিপরীতে ২৮০ টাকা ছিল।

এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে প্রতি রিয়ালের বিপরীতে ২২-২৩ টাকা ছিল। আর এখন রিয়ালপ্রতি ২৭ টাকা পর্যন্ত দর উঠেছে। দিনার, রিয়ালের মতো মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মুদ্রার দামও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরি ডলার, মালয়েশিয়ার রিঙ্গিতের বিপরীতেও টাকার মান কমেছে। গত মে মাসে প্রতি রিঙ্গিতের বিপরীতে ১৯ টাকা পেতেন প্রবাসীরা। বর্তমানে রিঙ্গিতপ্রতি প্রবাসীরা ২২-২৩ টাকা পাচ্ছেন। দুই মাস আগে সিঙ্গাপুরি ডলারের দর ছিল ৬২ টাকা। বর্তমানে ডলারপ্রতি ৬৭-৬৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের সময়ে ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুদ্রা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। রেকর্ড দামে তেল রপ্তানি করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুদ্রা আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। বিপরীতে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ইউরো ও বৃটিশ পাউন্ডের দাম কমেছে। ডলার এবং ইউরো সমান হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ প্রবাসীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, এক বছর আগে প্রতি ইউরোর বিনিময় মূল্য ছিল ১০২ টাকা। চলতি মাসে ইউরোর মূল্য ৯৪ টাকায় নেমে গিয়েছিল। বৃটিশ পাউন্ডের দাম কমে ১০৫ টাকায় এসেছিল। বর্তমানে কিছুটা বেড়ে ১১২ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ডলারের দরে লাগাম টানতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। অস্থির ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত দুই মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। মে মাসের শুরুতেও প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। আর গত রোববার প্রতি ডলার প্রায় ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত এ দামে দেশের কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ১০৫ টাকা দামেও ডলার কিনছে দেশের অনেক ব্যাংক। স্বল্প সময়ে টাকার এতবড় অবমূল্যায়ন বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের পাশাপাশি অন্য মুদ্রার দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কারণ এগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। যেমন; কেউ পণ্যের দাম ডলারের পরিবর্তে পাউন্ড বা দিনার-রিয়েল-এ পরিশোধ করতে চাইলো। তখনই অন্য মুদ্রার চাহিদা তৈরি হয় আর দামও বেড়ে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর ফলে দেশের রিজার্ভে চাপ বাড়বে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের আগে ও পরে বাজারে ডলারের সরবরাহ ও চাহিদা ভালো ছিল। কারণ, এ সময় অনেকেই বিদেশ থেকে ঈদ করতে দেশে এসেছিলেন। ফলে সরবরাহ বেড়ে যায়। আবার অনেকে ঈদের ছুটিতে বিদেশে গেছেন। ফলে ডলারের চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন খোলা বাজারে ডলার সংকট রয়েছে। ফলে চাহিদা বেশি থাকাই বেশি দামে সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে।

ডলার ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, খোলা বাজারে ডলার নেই, ব্যাংকেও সংকট। বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় ডলার কম পাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ডলার কিনে এখন আর হাতে রাখাটাই ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে। কখন হঠাৎ করে কমে যায় এ ভয় থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মুদ্রার বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়ায় প্রবাসীরা বৈধ পথে আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, মে মাসের তুলনায় জুনে সৌদি আরব প্রবাসীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। মে মাসে সৌদি প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ৩২ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। জুনে সৌদি আরব থেকে ৩৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলার দেশে এসেছে। কুয়েত থেকে গত মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। দেশটি থেকে জুনে ১৫ কোটি ৭৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। কাতার থেকে জুনে এসেছে ১১ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স, যা মে মাসে ছিল ১০ কোটি ৫১ লাখ ডলার।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, বাড়তি দাম পাওয়ায় প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

আরেক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, ঋণপত্রের (এলসি) দায়ের পাশাপাশি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এজন্য বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার কিনছে। কোনো ব্যাংক এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেটি কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে। এ কারণে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই ব্যাংকগুলো যেকোনো মূল্যে ডলার সংগ্রহ করছে। যে পরিমাণ এলসি দায় ব্যাংকগুলোতে তৈরি হয়েছে, তাতে সহসা ডলারের চাহিদা ও দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

  • শেয়ার করুন