প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০২২
দুইদিন আগে থেকেই বন্ধ বাস যোগাযোগ। আগের দিন বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ। সড়কে বাধা-তল্লাশি। এত বাধার পরও খুলনায় বড় সমাবেশ করেছে বিএনপি। বাধা টপকে সমাবেশ সফল করতে আগের দিনই সমাবেশে হাজির হন অনেকে। রাত যাপন করেন সমাবেশস্থল ও আশপাশের সড়কে। সকাল হতেই দলে দলে সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন নেতাকর্মীরা। দুপুরের আগেই লোকারণ্য হয়ে পড়ে সমাবেশ এলাকা। ব্যাপক জনসমাগম হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়ে যায় সমাবেশ। একে একে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা।
সমাবেশে অংশ নিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও আগের দিনই খুলনায় পৌঁছান। তাদের কাছে পেয়ে উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা রাতভর সমাবেশ স্থলের আশপাশে অবস্থান নিয়ে মিছিলে-স্লোগানে মুখর করে রাখেন। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের আহ্বান জানান। একইসঙ্গে নেতাকর্মীদেরও আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেন। বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকবে না। তাই তারা আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
এদিকে খুলনা বিভাগের ১০ টি জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও গুলিসহ ট্রলার ডুবিয়ে দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি। বাস, লঞ্চ বন্ধ থাকলেও নেতাকর্মীদের খুলনায় ঢুকতে বাধা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় লোকজন। নানা বাধা-বিপত্তির মুখে খুলনায় নেতাকর্মীদের উপস্থিতি দেখে রাতেই খুলনায় আসেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার রাতে সমাবেশস্থলে এসে নেতাকর্মীদের সমাবেশ সফল করার পরামর্শ দেন। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের ঢল নামে। রাত ১১টার মধ্যেই পুরো শহরে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের অবস্থান দেখা যায়। সারা রাত সমাবেশ স্থল থেকে শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা শোডাউন করেন। রাতেই শুরু হয় মঞ্চ তৈরির কাজ। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে রাতেই বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কের ওপরে, শহরের অলিগলি ও মার্কেটের সামনে মাদুর, পেপার ও পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। ভোরে আশপাশের এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন তারা। এদিকে সকাল ৯টার মধ্যে শহরের ডাকবাংলা থেকে শিববাড়ী মোড় এলাকা নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় নেতাকর্মীদের চাপ সামাল দিতে না পেরে অনেকেই পার্শ্ববর্তী সড়কে অবস্থান নেন। গতকাল সকাল ১০টা না গড়াতেই নেতাকর্মীদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না আশপাশের এলাকায়। বাস বন্ধ থাকায় নানা প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন নেতাকর্মীরা। বিএনপি নেতাকর্মীদের মিছিলে পুরো খুলনা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। মিছিলকারীরা দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিকৃতি বহন করেন।
অনেকের হাতে দলের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ দেখা গেছে। কেউ কেউ নেচে গেয়ে সমাবেশে যান এবং মিছিলে সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছেন। কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে সমাবেশের মঞ্চ থেকে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি দলীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সমাবেশে আসা নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে বাধা পেয়ে দফায় দফায় গাড়ি বদল করে, অটোরিকশা, ভ্যান, ট্রলারে করে সমাবেশে এসেছেন। অনেকে যোগ দিয়েছেন পায়ে হেঁটে। এদিকে সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়ে কৌশল পাল্টিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা আলাউদ্দিন মিয়া। তিনি বলেন, বিএনপি’র সমাবেশে যোগ দিতে শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে ২৫ জন নেতাকর্মী একসঙ্গে যাত্রা করেন। শনিবার সকালে খুলনায় পৌঁছান তারা। তিনি বলেন, শুক্রবার দুপুরের দিকে নেতাকর্মীদের নিয়ে মোটরসাইকেলে করে খুলনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে ছিলাম। পথে মোটরসাইকেল আটকে দেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। পরে বাড়ি ফিরে সমাবেশে যাওয়ার কৌশল খুঁজতে থাকেন তারা। শুক্রবার শেষরাতে লুঙ্গি পড়ে খুলনার উদ্দেশে যাত্রা করেন। পুরো পথ হেঁটেই আসেন তারা। এদিকে খুলনা রেলস্টেশনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় বেশকিছু জানালার কাঁচ। এছাড়া বৈকালী এলাকায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আগুন দেওয়া হয় বিএনপি’র দলীয় কার্যালয়ে। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, খুলনায় বিএনপি’র সমাবেশে বাধা দিয়েও ঠেকাতে পারেনি। সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে সরকারের পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশ। কিন্তু লাভ হয়নি। খুলনা বিভাগের প্রান্তরে প্রান্তরে জনস্রোত সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তিনদিন ধরে সমস্ত কিছু বন্ধ করে দিয়েছে। দুইদিন ধরে বাস বন্ধ করে দিয়েছে, নৌপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও গণতন্ত্রের লড়াইয়ের যে সংগ্রাম, তাতে বাধা দিতে পারেনি। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জনগণকে দমিয়ে রাখা যায় না। আজকে সেটা আবার প্রমাণ হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলে ১০ আসনও পাবে না আওয়ামী লীগ: ফখরুল
সরকারকে ফ্যাসিস্ট আখ্যায়িত করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এখন নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১০টি আসনও পাবে না। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এই অবৈধ সরকারকে বিদায় করা হবে। সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপনারা অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। সংসদ বিলুপ্ত করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। কারণ আপনাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।’
ফখরুল বলেন, ‘এই সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, আমাদের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয়করণ করেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে, মানুষ সেবা পায় না।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে যদি আমরা জনগণের অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে এই সরকারের পতন করতে পারি এবং জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন টেক-ব্যাক বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিয়ে আসো, কোন বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলাম। সমৃদ্ধির বাংলাদেশ, মানবিক বাংলাদেশ, মানবাধিকারের বাংলাদেশ, ভালোবাসার বাংলাদেশ। আমরা সেই বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই। তিনি বলেন, আমরা ভবিষ্যতে যদি রাষ্ট্র ক্ষমতার দায়িত্ব পাই তাহলে তরুণ-যুবকদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করবো। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো, চাকরির ব্যবস্থা করবো। ন্যায়বিচার করার ব্যবস্থা করবো। আর যারা মেগা প্রযুক্তির নামে মেগা দুর্নীতি করেছে তা তদন্তে কমিশন গঠন করবো।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, হাসিনা সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। তারা জানগণকে বঞ্চিত করে বিনা ভোটে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। তাই তার অধীনে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। হাসিনা সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, অন্যথায় সোজা কথায় বলছি, আপনারাও পালানোর পথ পাবেন না। এই জনগণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আপনাদের উৎখাত করবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্য আওয়ামী লীগ বাড়িয়েছে। এসব কথা বললে আওয়ামী লীগ ভয় পায়। ১৪ বছর ধরে বেগম খালেদা জিয়াকে নানাভাবে হয়রানি করছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে আটকে রেখেছেন। আমাদের নেতা তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্বাসনে রেখেছেন। খুলনাবাসীকে বলতে চাই, আরও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে রাজপথে নামতে হবে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অন্যায় আদেশ না পালনেরও আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের যুদ্ধটা পুলিশের বিরুদ্ধে না। পুলিশ বাহিনীকে বুঝতে হবে তারা জনগণের টাকায় চলে তাদের সেবা করার জন্যে। পুলিশ বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর বাসার চাকর-বাকর না; যে যা বলবে তাই শুনতে হবে। ভয় পাবেন না, সরকারের কোনো অন্যায় আদেশ পালন করবেন না।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, অচিরেই আমরা (বিএনপি) ক্ষমতায় যাচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যে তারা আমাদের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এর প্রতিশোধ নেয়া হবে। আমরা কখনো আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করবো না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। খুলনা থেকে শপথ, শেখ হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচন করতে দেবো না।
গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক এস এম শফিকুল আলম মনা। সমাবেশে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, মশিউর রহমান, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, সাবেক এমপি অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দীন, রকিবুল ইসলাম বকুল, ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, জয়ন্ত কুমার কু-ু, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান, এডভোকেট নেওয়াজ হালিমা আরলী, আমিরুজ্জামান খান শিমুল, যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এসএম জিলানি, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ, অধ্যাপক নার্গিস বেগম, মাসুদ অরুণ, সাবেক ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান রতন, ফজলুল হক, আমীর এজাজ খান, শফিকুল আলম তুহিন, মনিরুল হাসান বাপ্পী, তরিকুল ইসলাম জহির, আবু হোসেন বাবু, মহানগর মহিলা দল সভাপতি আজিজা খানম এলিজা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।