২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার,বিকাল ৫:০৯

মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে; দিশেহারা সাধারণ মানুষ

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২২

  • শেয়ার করুন

 

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমছে, তখন দেশের ইতিহাসে এক লাফে সর্বোচ্চ বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। শুক্রবার জ্বালানি তেলের এই দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর আরও চাপ বাড়বে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি (৪.৫ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে তাদের শর্ত পূরণ করতে ইউরিয়া সারের পর তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, তেলের দাম বাড়ানোর সম্ভাব্য অভিঘাত পড়বে- বাস ভাড়ায়, ট্রাকে পণ্য পরিবহনে, কৃষকের সেচের খরচে, খাদ্যদ্রব্যের দামে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচে এবং শিল্প উৎপাদন ব্যয়ে। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সামপ্রতিক বছরগুলোর হিসাবে সর্বোচ্চ। সেটা সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত ডিজেল ব্যবহারে যে খাতগুলোতে বেশি ব্যয় হয় তার মধ্যে; পরিবহন, কৃষিখাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পের উৎপাদন খাতে।

আর উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ভোক্তার ওপর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়বে। পরিবহন ভাড়ার প্রভাব সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষণীয়।

তিনি বলেন, পরিবহন মালিকরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, এর প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে। কৃষিখাত নিয়ে তিনি বলেন, কৃষিখাতে শুষ্ক মৌসুমে ডিজেলের মাধ্যমে সেচের ব্যবহারের ওপরও প্রভাব পড়বে। ফলে শাকসবজিসহ কৃষিপণ্যে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়বে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ক্যাপটিভ পাওয়ার অর্থাৎ ডিজেল ব্যবহার বন্ধের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। হয়তো এখনই তার প্রভাব পড়বে না। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে ডিজেল ব্যবহার করে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য কিছু ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি প্রভাব পড়বে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হচ্ছে। আর এই দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্‌কে দেবে। তিনি বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঋণের আলোচনার শর্ত হিসেবে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগটি যথাযথ হয়নি। বরং বিপিসি’র উদ্বৃত্ত যে অর্থ হয়েছিল সরকার তা না নিয়ে ভর্তুকি কাজে ব্যবহার করতে পারতো। ফলে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি না করলেও চলতো। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসে, সেক্ষেত্রেও সরকারের উচিত ছিল ক্যাপাসিটি চার্জের যে জায়গায় ভর্তুকি দিতে হয়, সেখান থেকে সরে আসার কৌশল খোঁজা।

অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদের পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফের ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘোষণা আসতে পারে। ঋণের জন্য আইএমএফের সঙ্গে সরকারের কী চুক্তি হয়েছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। তবে সারের পর তেলের দাম বাড়ানোয় এখন আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যে, ঋণ পেতেই আইএমএফের কথামতো তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে। কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেছেন, সরকার চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রিত লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে জ্বালানি ব্যয় কমাতে, অর্থাৎ সাশ্রয়ী হতে। এরমধ্যেই জ্বালানির দাম বাড়লো। এখন দুর্ভোগ আরও চরম আকার ধারণ করবে। সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় আরও নাভিশ্বাস হয়ে উঠবে।

ক্যাব সভাপতি বলেন, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করায় সব জিনিসপত্রের দাম আবারো চড়া হয়ে যেতে পারে। সাধারণ ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষজনের দুর্ভোগ বাড়বে। শিল্প উৎপাদন, পরিবহন খাত সবকিছুতে এর প্রভাব পড়বে। এতে করে একটা ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সংকট এখন চারদিকে। আসলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা সরকারের দেখা উচিত। তিনি বলেন, এর আগে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। তখন দেখা গেছে, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ বলেন, জ্বালানির সঙ্গে সবকিছু সম্পর্কিত। বেশির ভাগ জিনিসের সঙ্গেই জ্বালানির সম্পর্ক রয়েছে। আর সেগুলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে যখন প্রোডাকশন কস্ট বেড়ে যাবে অটোমেটিক সেটা গ্রাহক পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে। সরকার চাইলে ক্রমান্বয়ে বাড়াতে পারতো। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে রপ্তানি খাত হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী?দের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। শ?নিবার এফবিসিসিআই কার্যালয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, হঠাৎ দাম বাড়ায় বড় ধাক্কা আসবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্য না বাড়িয়ে সরকার চাইলে ধাপে ধাপে বাড়াতে পারতো।

এতে করে সরাসরি প্রভাব পড়তো না। হঠাৎ করে এত বেশি দাম বাড়ানোর কারণে এর প্রভাব আমাদের কৃষিতে পড়বে, পরিবহন-যাতায়াতে পড়বে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। সর্বোপরি সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হবে- উল্লেখ করেন এফবিসিসিআই? সভাপতি। তৈরি পোশাকখাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে, সময়মতো শিপমেন্ট দিতে পারবে না অনেক কারখানা। শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবি তুলবেন। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এই তথ্য জানিয়েছে। বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আমরা লোডশেডিংয়ের কারণে এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলাম। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো। আসলে জ্বালানি সমস্যা এখন বৈশ্বিক। আমাদের খরচও বেড়ে গেল।

সব মিলিয়ে আমাদের এখন সবকিছুতে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কারণে দেশের নিট পোশাক শিল্প উদ্যোক্তাদের রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে আলোচনায় বসে খাতওয়ারি বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি বলে বিকেএমইএ মনে করে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সামগ্রিক বিষয়ে অতীতের মতোই সরকারের ব্যবসা-বান্ধব নীতিগত সহায়তা কামনা করছে বিকেএমইএ।

  • শেয়ার করুন