২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,বিকাল ৪:৩৩

গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ধুকছে দেশের শিল্পখাত

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২২

  • শেয়ার করুন

 

গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কমছে। রপ্তানির ক্রয়াদেশও কমে যাচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান নিয়ে। এমন অবস্থায় ধুঁকছে দেশের শিল্পখাত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রয়োজনে দাম বাড়িয়ে হলেও যেন তাদের কারখানায় গ্যাসের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে সামনে এই খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। রপ্তানি কমে যাবে। এতে রিজার্ভে আরও বড় প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি আকতার হোসেন অপূর্ব বলেন, গত জুলাই মাস থেকে কলকারখানায় ব্যাপক আকারে গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। জুলাইয়ের পর থেকে পিএসআই জিরো ছিল। যার কারণে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বয়লার এবং স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লোডশেডিং সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। নন স্টপ লোডশেডিং চলছেই। বিদ্যুতের সমস্যার কারণে ডিজেল বাবদ অতিরিক্ত ১ কোটি টাকারও বেশি খরচ করতে হচ্ছে। এভাবে তো বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না। এতে বায়ারদের মধ্যে নেগেটিভ মেসেজ যাচ্ছে। এতে বায়ার হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের যারা প্রতিযোগী রয়েছে বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারে কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট নাই। এটিকে পুঁজি করে তারা বায়ারদেরকে বোঝাতে পারবে। তখন বায়াররা ওইসব দেশে চলে যেতে পারে। আর একবার বায়ার চলে গেলে তারা আর ফিরে আসবে না। তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানি সেপ্টেম্বরে নেগেটিভ গ্রোথ ছিল। এ মাসেও নেগেটিভ। এটার কারণ হলো আমাদের অর্ডার আছে। কিন্তু শিপমেন্ট করতে পারিনি। এভাবে চলতে থাকলে বায়াররা আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তারা অল্টারনেটিভ সোর্স খুঁজবে। তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা থাকার কারণে ৪২ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। ফলে আমাদের রপ্তানির পরিমাণও স্বাভাবিকভাবেই কমবে। এতে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের উপরে চাপ পড়বে। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে বস্ত্রখাত মুখ থুবড়ে পড়েছে।

দেশে শিল্পের কোনো কাঁচামাল উৎপাদন হয় না। একমাত্র কাঁচামাল আছে গ্যাস। গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই শিল্প গড়ে উঠেছে। এখন গ্যাস সংকটে টেক্সটাইল খাত নাজুক অবস্থায় আছে। গাজীপুর ও নরসিংদীর শিল্পাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ৬০ শতাংশ বস্ত্রকল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত সংকট সমাধান করে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি হারাবেন শ্রমিকরা। ব্যাংকও তাদের পুঁজি হারাবে। বিটিএমএ’র সভাপতি বলেন, গত মার্চে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে করে কারখানাগুলো উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। উৎপাদন এখন তলানীতে গিয়ে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে ১ ডলার ২৫ সেন্ট খরচ হলেও দিনের অর্ধেক সময় কারখানা বন্ধ থাকার কারণে তা বেড়ে আড়াই ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে।

কাপড় রং করার ডাইং কারখানাগুলোও লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, শিল্পকারখানায় ৭-৮ ঘণ্টা গ্যাস-বিদ্যুৎ থাকছে না। তেলের দাম বাড়ানোর পর লোডশেডিং বেড়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় শিল্পের গ্যাসের লাইন ও আবাসিকে ব্যবহারের গ্যাসের লাইন আলাদা করার বিষয়টি ভাবতে হবে। তাছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ২৪ টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করা হচ্ছে, এর যৌক্তিকতা আছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন করতে ৩০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লাগবে। এখন জ্বালানির অভাবে শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে সেই লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করবো। এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি এবং হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, চলতি বছরের শুরুতে চীন-ভিয়েতনাম থেকে ব্যবসা বাংলাদেশে চলে এসে ৩৮ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর এখন রপ্তানি সাড়ে ৭ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে।

গ্যাস সংকটের কারণে শিল্পকারখানায় রাতের পালায় উৎপাদন বন্ধ থাকছে জানিয়ে এ কে আজাদ বলেন, স্থানীয় বিভিন্ন খাত থেকে ৫ শতাংশ গ্যাস শিল্প খাতে দিতে পারলে রাতের পালা চালু করা সম্ভব হবে। তাহলে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করতে হবে না। তিনি বলেন, গ্যাস সংকটে গত দেড় মাসে রাতে কারখানা চালাতে পারিনি। সন্ধ্যার পরপরই বন্ধ করে দিতে হয়। এ অবস্থায় কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে, নইলে শ্রমিকদের বেতন কীভাবে দেবো। আগামী ৬ মাস থেকে এক বছর এই অবস্থা থাকলে শিল্প কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা ভেবে দেখা দরকার। আবাসিক ও সিএনজি থেকে শিল্পে গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান তিনি। মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এই সময়ে জ্বালানির উপর ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ ভ্যাট ও কর আরোপ করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে গত কয়েক মাসে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ক্রয়াদেশ, উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের মতো সংকটে ভুগছে না সেসব দেশ। ফলে তারা ক্রেতাদের আস্থা পাচ্ছে, আর আমরা আস্থা হারাচ্ছি।

বেশি দামে হলেও গ্যাস চান শিল্প মালিকরা: বেশি দামে হলেও গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন দেশের শিল্প মালিকরা। এই দাবির প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বৈশ্বিক এই সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধান করা দরকার। ব্যবসায়ীদের সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বুধবার অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, পরিকল্পিত এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন করলে এককভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে সুবিধা পাওয়া যেতো। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে যত্রতত্র কারখানা করায় আলাদা করে গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, গাজীপুর-আশুলিয়া-নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের চাপজনিত সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে। ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৭ শতাংশ ও শিল্পে ১৮ শতাংশ গ্যাস দেয়া হচ্ছে। দেশীয় ও আমদানি মিলে এখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে খরচ পড়ছে ২৮ টাকা ৪২ পয়সা।

আর প্রতি ইউনিট বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সায়। সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, করোনা মহামারি পরিস্থিতি পরিকল্পনামতো এগোতে দেয়নি। শিল্পকারখানায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। ব্যবসায়ীদের সমস্যা যথাযথভাবে চিহ্নিত করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বর্তমান সমস্যা বৈশ্বিক। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ চায় শিল্প মালিকরা। করকাঠামো পুনর্গঠন করলে মূল্য সমন্বয় সহনীয় থাকবে বলেও মনে করেন তিনি। মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি, বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস এসোশিয়েশন বাংলাাদেশ স্টিল মিলস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পেপার মিলস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ স্মল অ্যান্ড ক্যাপটিভ পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা।

  • শেয়ার করুন