৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার,দুপুর ১:১২

নতুন ইতিহাস গড়লো তালেবান!

প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২১

  • শেয়ার করুন

দু’দিন আগে এক ফৌজি বন্ধু আমায় প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা বলুন তো আমেরিকা যে তালেবানের কাছে আফগানিস্তান ছেড়ে আসতেছে, এর পেছনে ডক্টরিনটা কি? আমি জবাবে বলেছিলাম, হয় আমেরিকার সাথে তালেবানের কোনো গোপন চুক্তি হয়েছে যা আরও পরে জানা যাবে, আর দ্বিতীয় কারণটা হলো সম্ভবত পরাজয় এড়াতে আমেরিকা পাততাড়ি গুটিয়েছে, তারপর যা হয় হবে!

২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধংসের পরে বিনা লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ব্যাপক বোমাবাজি করে তালেবানকে জোর করে ক্ষমতা থেকে সরায়। মার খেয়ে তালেবানরা ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ২০ বছর পরে সেই তালেবানরাই নতুন রূপে ক্ষমতা পূণর্দখল করে খুব দ্রুতই, অনেকেটা বিনা রক্তপাতে।

১৫ আগস্ট সকাল থেকেই সাজ সাজ রবে তালেবানরা আফগান রাজধানী কাবুল চারিদিক ঘিরে ফেলে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, কাবুল দখল করতে ৯০ দিনের মত সময় লাগতে পারে, কিন্তু তাদের সে আন্দাজকে ভুল প্রমান করে দু’সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যেই কাবুলে পৌছে যায় তালেবান। এর আগে রোববার সকালে গুরুত্বপূর্ণ জালালাবাদ দখল এবং শনিবার রাতে আফগানিস্তানের উত্তরের মাজার-ই-শরিফ দখলের পর থেকেই কাবুলের পতন ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। চারিদিকে অবস্থা বেগতি দেখে আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকালে জানিয়েছিলেন, কাবুলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এক রেকর্ডেড ভাষণে যুদ্ধ না করার অঙ্গীকার করে রাতেই গোপনে দেশ ছাড়েন। তালেবান কাবুলে ঢোকার পরে প্রথমে আত্মসমর্পন করে আফগান পুলিশ। ধীরে ধীরে কাবুলের রাস্তাঘাট দখল করে প্রেসিডেন্ট প্যালেস কব্জায় নেয় তালেবান। অন্যদিকে তখন গ্রীনজোনে মার্কিন দূতাবাসের চত্তর থেকে হেলিকপ্টার যোগে কূটনীতিকদের সরানোর কাজ চলতে থাকে। রোববারও রাতভর কাবুল এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে হাজার হাজার বিদেশী আফগানিস্তান ছাড়ে, যদিও তালেবানরা প্রতিশোধ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, এবং দূতাবাসগুলোকে কার্যক্রম চালু রাখার আহ্বান জানিয়েছে। বিরোধীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে এবং নারীদেরকে শিক্ষা, চাকরি, এবং বাইরে যাবার অনুমতির কথা জানিয়েছে তালেবান। দিনের শেষে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আহমদ জালালিকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেয় তালেবান। এভাবেই কাবুলে ক্ষমতার পালা বদল ঘটে।

১৫ই আগস্ট ঠিক যে সময়ে ভারতে স্বাধীনতা দিবস পালনের উৎসব হওয়ার কথা, তখন কাবুল পতনের খবরে শোকের আবহ দেখা যায় দিল্লিতে। কারণ গত ২০ বছরে ভারত আফগানিস্তানে বিশাল লগ্নি করেছিল (এক হিসাবে ৯ বিলিয়ন ডলার), হাজার হাজার ভারতীয় আফগানিস্তানে কাজ করতো। মুলত ২০০১ সালের পর আমেরিকা আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংগঠনগুলো পুনর্গঠনের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল ভারতের হাতে। মানে ভারত হয়েছিল আমেরিকার লোকাল এজেন্ট। আছাড়া আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ভারতের পুতুল সরকার হিসাবে সুবিদিত। ভারতের এই বিপুল বিনিয়োগের পেছনে অর্থনৈতিক কারণের চেয়ে কৌশলগত দখল কারণ যে বড় তা স্পষ্ট হয় ঘোষিত অঘোষিতভাবে দেশটিতে ১৬টির মতো ভারতীয় মিশন চালানোয়। তালেবানদের অগ্রাভিযানের মুখে ভারত তাদের হাজার হাজার কূটনীতিক ও লোকজন সরিয়ে নেয় দ্রুতই। ভারত মুখে তালেবান বিরোধতা করলেও বাধ্য হয়ে গোপনে রাশিয়া ইরান এবং কাতারের সহায়তায় তালেবানের সাথে তিন দফা বৈঠক করেছে দিল্লি। এসব বৈঠকে ভারতীয় বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক তৎপরতা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে সহায়তার আশ্বাস চেয়েছিল দিল্লির কর্মকর্তারা; কিন্তু অন্য কোনো দেশ বিশেষত পাকিস্তান ও চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না দেয়ার ব্যাপারে তালেবানদের অবস্থান ছিল কঠোর। তারা বলেছে, ভারতের বিরুদ্ধে যেমন তারা আফগানিস্তানের মাটি কাউকে ব্যবহার করতে দেবে না তেমনিভাবে অন্য প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধেও আফগানিস্তানের ভূখণ্ড কাউকে ব্যবহার করতে তারা দেবে না। ফলে আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে দিল্লি পাততাড়ি গুটায় দ্রুত। মোটকথা, আফগানিস্তানে ভারতের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়।

কিন্তু এই তালেবান আসলে কারা? এত দ্রুত তাদের সফলতার কারণই বা কী?
পশতু ভাষায় তালেবান মানে হচ্ছে ‘ছাত্র’। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তানের দখল ছেড়ে যায়, তখন উত্তর পাকিস্তানে এই তালেবান আন্দোলনের জন্ম হয়। এর পেছনে আমেরিকান সহায়তা ছিল বলে প্রচার রয়েছে। এই আন্দোলনে মূলত পশতুন অর্থাৎ পশতুভাষীদের প্রাধান্য ছিল। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানরা ইরান সীমান্তবর্তী আফগান প্রদেশ হেরাত দখল করে নেয়। আর এর ঠিক এক বছর পর তারা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে। তারা প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দীন রাব্বানির সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৮ সাল নাগাদ তালেবান আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ২০০১ সালে আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ধংসের পরেই ঘটে যত বিপত্তি। টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র, আর সেই লাদেন নাকি লুকিয়ে আছে আফগানিস্তানের পাহাড়ে। যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে ‘ওয়ার অন টেরর’, ব্যাপক বোমা হামলা চালায় আফগানিস্তানে, সেখানে ক্ষমতায় ছিল তালেবান। তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে বহুজাতিক বাহিনী ঢোকায় যুক্তরাষ্ট্র, বসায় পুতুল সরকার। অবস্থা বেগতিক দেখে তালেবানরা সড়ে পরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

এই ২০ বছরে আমেরিকা আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠিয়েছে হাজার হাজার, আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে আড়াই লক্ষ মানুষ নিহত হয়, নিজেদের আড়াই হাজার সৈণ্যও হারায়। কিন্তু এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক চাপ, এবং হাজার হাজার সৈন্য বিরূপ আবহাওয়ায় রেখে প্রতিদিন লোকক্ষয় ছাড়া আর কী অর্জন তা নিয়ে মার্কিনীরা নিজেরাই সন্দিহান হয়ে পড়ে। আফগানিস্তান ছেড়ে আসার জন্য অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়তে থাকে। বছর চারেক আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাস্পই প্রথম আফগান ছাড়ার ঘোষণা দেন। ২০১৮ সাল থেকে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনা চলতে থাকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে কাতারের রাজধানী দোহায় দুই পক্ষের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয়, তার শর্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং তালেবানও আর মার্কিন বাহিনীর ওপর কোন হামলা চালাবে না। চুক্তির আরও শর্তের মধ্যে ছিল তালেবান আর আল কায়েদা কিংবা অন্য কোন জঙ্গী সংগঠনকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় দেবে না এবং আফগান শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাবে।

নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের এপ্রিলে ঘোষণা করেন, ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে। আর আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের খবরের পরপরই আফগানিস্তানের চারিদিকে তালেবানের জয়-জয়কার শুরু হয়। প্রতিদিনই তারা আফগানিস্তান জুড়ে শহর-বন্দর-গ্রামে হামলা চালাচ্ছে, দখল করে নিচ্ছে আফগান সরকারের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি। ২ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম ঘাটি ছেড়ে যায় মার্কিন বাহিনী, দখলে নেয় তালেবান। একে একে পতন ঘটতে থাকে প্রাদেশিক রাজধানীগুলির। ৮ আগস্ট একই দিনে তিনটি প্রাদেশিক রাজধানী দখলে নেয় তালেবান। ১২ আগস্ট দখলে নেয় গুরুত্বপূর্ন নগরী হেরাত, কান্দাহার, এবং গজনী। ১৫ আগস্ট কাবুল অভিযানের আগেই সকল প্রাদেশিক রাজধানী ও বড় বড় শহর দখলে আসে তালেবানের।

প্রশ্ন হলো, আমেরিকান অস্ত্রে সজ্জিত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা তিন লাখের মতো। বিমান বাহিনীও রয়েছে তাদের। অন্যদিকে তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজারের মতো, তাদের কোনও ইউনিফর্ম নেই, বেশিরভাগহ যোদ্ধার পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই, বিমান সাপোর্ট তো নেইই। তারপরেও তালেবান কিভাবে এত দ্রুত বিজয় অর্জন করছে। অধিকাংশ পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক বর্তমান অবস্থা দেখে বলছেন, ন্যাটো বাহিনী তালেবানের তেমন কোনও ক্ষতি তো করতে পারেইনি, বরঞ্চ গত ২০ বছরের মধ্যে তালেবান এখন সবচেয়ে শক্তিধর। গত ১০ বছর ধরে এই কৌশল নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়েছে তালেবান। “তারা জানতো, আমেরিকা এক সময় আফগানিস্তান ছাড়বেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিল তারা।” তারা সময় বুঝে হামলা চালিয়েছে।

তবে কেবল হামলা করে গোটা দেশ দখল করেনি তালেবান। মুলত আলাপ আলোচনা এবং নেগোসিয়েশন করেই একেকটি এলাকা তারা দখলে নিয়েছে। এর মূল কারণ তালেবানের ব্যাপক গণভিত্তি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ও প্রশাসনে তালেবান সমর্থিতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আর এই ভিতটা এতই মজবুত ছিল যে ঘরে ঘরে, অফিসে আদালতে, স্থানীয় সরকারে, এমনকি আফগান বাহিনীতেও তালেবানের উপস্থিতি ছিল। ফলে বিভিন্ন এলাকার কামান্ডাররা এবং স্থানীয় প্রশাসকরা আলোচনার ভিত্তিতে তালেবানের কতৃত্ব মেনে নেয়। যুদ্ধ ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার সুযোগ হাতছাড়া করেনি আফগানবাসীরা। তাছাড়া প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি যে ভারত-আমেরিকার পুতুল সরকার, তা জানতো এবং তার প্রতি আস্থাও ছিল না আফগানদের। মুলত ব্যাপক গণভিত্তির উপর ভর করেই তালেবানের এ কৌশলগত বিজয়।

তবে ২০ বছর আগে তালেবান আর বর্তমান তালেবান এক জিনিস নয়। বর্তমানের তালেবান অনেক আধুনিক, স্মার্ট এবং অতীদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগেভাগেই ঘোষণা করেছে, আগেকার তালেবান শাসনের মত এবারে তারা নারীদের শিক্ষায় বাধা দিবে না, তাদের চাকরি এবং বাইরে যাওয়ায় কোনো বাধা থাকবে না, প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মতো শাস্তি থেকে তারা সরে আসবে। তবে আফগানিস্তানকে তারা ইসলামিক আমিরাত ঘোষণা করবে, এবং শরীয়া আইন চালু করবে। এখন দেখা যাক, তারা কিভাবে জনগনের ম্যান্ডেট লাভ করে, আর শরীয়া আইনকে কিভাবে যুগোপযোগী করে সমালোচনাবিহীন ভাবে কার্যকর করতে পারে। তবে সম্ভাব্য আফগান প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তালেবান প্রধান আমির আল মুমিনিন হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা, যিনি নিজে সাবেক প্রধান বিচারপতি।

(মোহাম্মদ শামসুল আলম এর টাইমলাইন থেকে)

  • শেয়ার করুন