৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার,সকাল ১০:৩৮

শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আবারো আলোচনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২১

  • শেয়ার করুন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান সম্প্রতি যে নিয়োগ দিয়েছেন তা নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠেছে। এবার তার মেয়াদের শেষ দিনে নিয়োগ দেয়া একজন শিক্ষককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ই মে মি. সোবহান নিয়োগপত্র ইস্যু করেন এবং পরদিন ৬ই মে তার শেষ কর্ম দিবসে তিনি শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে ১৪১ জনকে অস্থায়ীভাবে বা অ্যাডহকভিত্তিতে নিয়োগ দেন।

নিয়োগের ওই তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তান-স্ত্রী-স্বজন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী আছেন বলে জানা গেছে।
সেসময় অভিযোগ ওঠে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালার বাইরে গিয়ে তাদের অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে মি. সোবহান বলেছেন, মানবিক কারণেই তিনি এই নিয়োগ দিয়েছেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৌশল অনুষদভুক্ত ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়া ইন্দ্রনীল মিশ্রর একাডেমিক ফল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তার যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে ব্যাপক সমালোচনা দেখা যাচ্ছে।
তবে ইন্দ্রনীল মিশ্রর বাবা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্র দাবি করেছেন, এ ধরণের অভিযোগ তুলে তার এবং তার ছেলের সম্মানহানির চেষ্টা করা হয়েছে।
ইন্দ্রনীল মিশ্রর অনার্স পরীক্ষার ফলাফল থেকে জানা গেছে যে, তিনি অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেছেন।
আবার যে ১৪ জন শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তার মধ্যে ইন্দ্রনীল মিশ্রর মেধাক্রম দশম স্থানে।
এছাড়া একমাত্র তিনিই অনার্সের একটি কোর্সে ফেল করেন। যদিও পরে ওই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে তিনি পাস করেছেন।
ফলাফল খারাপ হওয়ায় তিনি এমএসসিতে থিসিস গ্রুপে যাওয়ার সুযোগ পাননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ওয়ার্ড কোটায় বা পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক পদে ইন্দ্রনীল মিশ্রের নিয়োগ নিয়ে এমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ায় বিভাগের সভাপতি এমদাদুল হক বেশ বিব্রত।
তিনি জানান, আমরা চেয়েছি নিয়োগ প্রক্রিয়ার নিয়মেই যেন সব হয়। সার্কুলারে যে যোগ্যতা দেয়া হয়েছে সেই যোগ্যতা যাচাই করেই যেন শিক্ষক বাছাই হয়। মৌখিক পরীক্ষা বা ভাইভার দিন ধার্য হলেও তাদের কোন পরীক্ষা নেয়া হয়নি। তারপরও কিভাবে নিয়োগ হল জানিনা। আমরা এমনটা চাইনি।
এদিকে বিদায়ী উপাচার্য যে অ্যাডহকভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন সেটাও নিয়ম বহির্ভূত বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা।
নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রথম শ্রেণি থাকা বাধ্যতামূলক না হলেও আবেদনকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সাধারণত মেধাক্রমের প্রথমদিকে থাকা শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়োগ বিধি অনুযায়ী, ইন্দ্রনীল মিশ্রর শিক্ষক হওয়ার সব ধরণের যোগ্যতা রয়েছে বলে দাবী করেছেন অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্র।
তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স, এই চারটির যেকোনো তিনটিতে ফার্স্ট ক্লাস পেতে হয়।
“সে হিসেবে ইন্দ্রনীল এসএসসি এবং এইচএসসি-তে এ প্লাস এবং মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস অর্জন করেছেন। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ৮ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আছে” বলেন তিনি। সেইসাথে ইন্দ্রনীল মিশ্রের তিনটি পাবলিকেশন আছে বলেও তিনি জানান।
তিনি বলেন, অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণী পেলেও শিক্ষক পদের জন্য অন্যান্য যোগ্যতায় ইন্দ্রনীল মিশ্র টিকে যাওয়ায় তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এরপরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে একপেশে খবর প্রচার ও অনুমতি ছাড়া ছবি প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক মিশ্র।
তবে এবিষয়ে ইন্দ্রনীল মিশ্রের সাথে একাধিকবার সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি অনুযায়ী, শিক্ষক পদে আবেদনকারীর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার পর সিন্ডিকেটের অনুমোদন পেলে আবেদনকারী শিক্ষক পদে কাজ করতে পারবেন।
তবে জরুরি-ভিত্তিতে লোকবলের প্রয়োজন তাহলে পরিকল্পনা কমিটি , বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অ্যাডহকের সুপারিশ করে থাকে।
এই নিয়োগের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানা হয়নি বলে অভিযোগ করছেন উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা।
কোন সুপারিশ ছাড়া বা সিলেকশন বোর্ড হওয়ার আগেই উপাচার্যের সরাসরি অ্যাডহক নিয়োগ দেয়ার কোন এখতিয়ার নেই। তাই মি. সোবহানের এভাবে অ্যাডহক দেয়া অযৌক্তিক বলে জানিয়েছেন মি. সাহা।
সাধারণত ৬ মাস মেয়াদে একজন শিক্ষককে অ্যাডহকে নিয়োগ দেয়া যায়, যেটার মেয়াদ উপাচার্য চাইলে বাড়াতে পারেন।
অধাপক সাহা বলনে, তবে এ ধরনের নিয়োগ দিতে ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষা নিতেই হয়। যে নিয়ম এবারে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
উপাচার্য আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নিয়োগে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, যা এই নিয়োগ ইস্যুতে আবারও সামনে আসে।
নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ওঠায় ওই দিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রে এ নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে।
সেইসঙ্গে ইউজিসির সদস্য ড. মোহাম্মদ আলমগীরকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এরিমধ্যে কমিটির প্রতিবেদন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে কি বলা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে ২০১৭ সালে, মি. সোবহান নিজের মেয়ে ও জামাতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করেছিলেন এবং এই শিথিল নীতিমালার আওতায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।
পরে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগের প্রমাণ পাওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয়।
শেষ পর্যন্ত সেই নিয়ম ভেঙ্গে মি. সোবহান তার শেষ কার্যদিবসে ওই ১৪১ জনকে অ্যাডভিত্তিক নিয়োগ দেন। যেটা ওইদিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবৈধ ঘোষণা করে।
যদিও সে সময় মি. সোবহান বলেছিলেন যে, শেষ দিনে তিনি যেসব নিয়োগ দিয়েছেন, সেগুলো আগেই নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে এসব নিয়োগ আটকে ছিল।
মানবিক কারণেই তাদেরকে চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
মি. সোবহান সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত টানা ৮ বছর কোন নিয়োগ হয়নি। এই নিয়োগ আগেই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। কোভিডের জন্য ভাইভা নেয়া স্থগিত করা হয়। ”
“এই নিয়োগে যারা প্রার্থী ছিল, ভাইভা ছাড়া তাদের সমস্ত যাচাই বাছাই হয়ে গেছে। তাই মানবিক কারণে, তাদের জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয় এজন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এই নিয়োগ তাদের প্রাপ্য। আমি তো ব্যক্তি স্বার্থে নিয়োগ দেই নাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা মনে করেন যে শিক্ষক পদে মেধাবীদের আনতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও শর্ত আরোপের প্রয়োজন।

  • শেয়ার করুন