২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার,রাত ৪:৩৫

আশ্রয়ের খোজে সিলেটের মানুষ

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২২

  • শেয়ার করুন

 

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ নগরের মানুষও বাসাবাড়ি ছেড়ে ছুটছে আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু ঠাঁই হচ্ছে না কোনো কেন্দ্রেই। ৩৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাসাঠাসি করে মানুষ কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে। বসার জায়গাও নেই অনেক কেন্দ্রে। এরপরও আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ ছুটাছুটি করছে। খাবার সংকট তীব্র। বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই বহু এলাকায়। উপশহরের অবস্থা ভয়াবহ।

মূল রাস্তায় বুক সমান পানি। প্রতিটি বাসার নিচতলা ডুবে গেছে। দু’তলা ও তিনতলায় আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ। তারা গত দু’দিন ধরে অভুক্ত। উপশহরেই পানিবন্দি ৫০ হাজার মানুষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আটকা পড়াদের উদ্ধারে নৌকা খোঁজা হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল সন্ধ্যায়ও প্রবল বেগে পানি ঢুকেছে উপশহরে। কোথাও কোথাও সাঁতরে আশ্রয়ে ছুটছে মানুষ। বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট হয়েছে। গোটা এলাকার দোকানপাটেও পানি। পণ্য সংকটও দেখা দিয়েছে। এত মানুষ পানিবন্দি; জনপ্রতিনিধিরাও অসহায় হয়ে পড়েছেন। খাবার দেয়া যাচ্ছে না।
যারা বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়ছেন তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। নৌকা চলছে সিলেট নগরীর অভিজাত উপশহরে। এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সবুর বিকালে জানালেন- এখন আর অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। উদ্ধার করে নিতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও মানুষে ঠাসা। খাবার নেই, পানির সংকটে মানুষ হাহাকার করছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালেহ আহমদ সেলিম পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রবাসীদের কয়েকটি বাসায় বন্যা আক্রান্ত মানুষদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সুবহানীঘাট এলাকা পর্যন্ত কোমর পানি। যানবাহন চলাচলও কমে এসেছে। সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকা ১৪নং ওয়ার্ড। ছড়ারপাড়, মাছিমপুরের কোথাও বুক, কোথাও কোমর সমান পানি। বাণিজ্যিক এলাকা কালীঘাটের অবস্থা ভয়াবহ। মূল রাস্তায় কোমরপানি। চাউল বাজার, পিয়াজ পট্টিসহ সব আড়তই পানির নিচে। দোকানিরা হা-হুতাশ করছেন। জেলা প্রশাসকের তরফ থেকে খুলে দেয়া হয়েছে পাইলট স্কুল। ব্যবসায়ীরা পণ্য বাঁচাতে অবিরাম চেষ্টায় ব্যস্ত। শ্রমিক তো আছেই, ব্যবসায়ীরাও পণ্য টেনে আনছেন পাইলট স্কুলে। প্রায় ৫০ হাজার বস্তা চাল, ডাল, পিয়াজ পানিতে ভিজে গেছে।

কান্না করছেন অনেক ব্যবসায়ী। চোখের সামনে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার পণ্য। চাউল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমদ জানালেন- হাজারো দোকানে পানি ঢুকেছে। সবারই গোডাউন এবং ব্যবসা একতলায়। রাতারাতি পানি উঠে যাওয়ার কারণে অর্ধশত কোটি টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। তিনি জানান- যেটুকু পারছি আমরা পাইলট স্কুলে নিচ্ছি। ব্যবসায়ীরাও পিঠে করে চাল, পিয়াজের বস্তা বহন করছেন। এক মাস আগে যে পরিমাণ পানি হয়েছিলো; এবার তার দ্বিগুণ হয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। কালিঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটে পণ্য সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্যবাহী ট্রাক ঢুকতে পারছে না। এমন অবস্থা সিলেটের অপর বাণিজ্যিক এলাকা কাজিরবাজারে। সুরমা মার্কেটের সামনে থেকে বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি। কাজিরবাজারের প্রতিটি দোকানে কোমর সমান পানি। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার কারণে তারা দোকান খুলতে পারছেন না। ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিকন্দর আহমদ বিকালে জানিয়েছেন- তার ওয়ার্ডের ৮০ ভাগ এলাকায় পানি। বহু মানুষ পানিবন্দি। চারটি আশ্রয় কেন্দ্রেও মানুষে জায়গা হচ্ছে না। খাবার সংকট চরমে।

মানুষের আহাজারি চলছে। কিছু করা যাচ্ছে না। তিনি জানান- যেসব এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন তাদের উদ্ধার করা হচ্ছে। বাসা বাড়ির দোতলা, তিনতলায় নিয়ে রাখা হচ্ছে মানুষদের। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে বলে জানান তিনি। নদী তীরবর্তী ১০নং ওয়ার্ড। শতভাগ এলাকা প্লাবিত। এলাকাগুলোতে বুক সমান পানি। ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় পানি। স্থান সংকুলান হচ্ছে না। একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটছে মানুষ। স্থানীয় কাউন্সিলর তারেক আহমদ জানিয়েছেন- ৮ আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে প্রতিটিতে গড়ে ৩০০ করে মানুষ উঠেছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে বসারও জায়গা নেই। নতুন করে আশ্রয়হারা মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। তিনি বলেন- এখন কেবল আশ্রয়ের খোঁজে থাকা মানুষকে সাহায্য করা হচ্ছে। মানুষের জীবন বাঁচানোই এখন বড় কাজ। খাবার নিয়ে রাতে চিন্তা করা হবে। তবে- কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার পাঠানো হচ্ছে। টাকা দিয়েও শুকনো খাবার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি। জানান- তার এলাকায় গত দু’তিনদিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। কিছু কিছু এলাকায় গ্যাস সংযোগ স্বাভাবিক রয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ না থাকার কারণে মানুষের খাদ্য সংকট ও দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। নগরীর তালতলা। গোটা এলাকাতেই পানি আর পানি। ১৩নং ওয়ার্ডের আওতাধীন কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিদ্যুৎ নেই। দুপুরের দিকে স্থানীয় কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত সন্তু কয়েকটি বাসায় শুকনো খাবার দিয়েছেন। তিনি জানান- আশ্রয়কেন্দ্রেও মানুষের জায়গা হচ্ছে না।

এদিকে- ইতিমধ্যে একাংশ বন্যাকবলিত হওয়ায় সিলেট নগরীর একাংশ ও সুনামগঞ্জ জেলা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় পড়েছে। বিদ্যুৎ স্টেশনে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- যে সকল যন্ত্রপাতি রয়েছে, সেগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়লে পুনরায় মেরামত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এজন্য কোনোভাবে যেন পানি না ঢোকে সেই ব্যবস্থা করার কাজ চলছে। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন- এই মুহূর্তে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি কুমারগাঁও বিদ্যুৎ স্টেশনকে। আর ৫/৬ ইঞ্চি পানি বাড়লে এই কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলে গোটা সিলেট বিভাগের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এমনটি হলে কার্যত সিলেট বন্যার ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার, আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা সর্বাত্মক কাজ করছেন। পানিবন্দি মানুষের জন্য সিসিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে জরুরি বৈঠক করা হবে। এ পরিস্থিতিতে কন্ট্রোল রুম খোলার প্রক্রিয়া চলছে।

এদিকে- দ্বিতীয় দফায় বন্যায় সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি মানুষদের দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করে তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরী। গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রথম দফা বন্যার সময় আমরা দাবি জানিয়েছিলাম সিলেটকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে বন্যার্তদের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য সহায়তা প্রদানপূর্বক পুনর্বাসন করতে কিন্তু সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। এখন মাত্র এক মাসের মধ্যেই সিলেটে আবারো ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। আমরা বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার পরবর্তী সময়েও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বন্যা দুর্গতদের দীর্ঘমেয়াদি পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানপূর্বক পুনর্বাসন করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। নেতৃবৃন্দ বন্যা দুর্গত এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের সকল নেতাকর্মীদের পানিবন্দি মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানান।

  • শেয়ার করুন